Home লাইফ স্টাইল বিনোদন নুসরাত থেকে রাহাত: কাওয়ালি ও সুফি সঙ্গীতের কিংবদন্তির উত্তরাধিকার

নুসরাত থেকে রাহাত: কাওয়ালি ও সুফি সঙ্গীতের কিংবদন্তির উত্তরাধিকার

নুসরাত থেকে রাহাত: কাওয়ালি ও সুফি সঙ্গীতের কিংবদন্তির উত্তরাধিকার

0

দুই প্রজন্ম, দুই নাম, কিন্তু সুরের ধারা এক। সুফি সঙ্গীত ও কাওয়ালির এই মহীরূহরা হলেন নুসরাত ফাতেহ আলী খান ও তাঁর ভাতিজা রাহাত ফাতেহ আলী খান। পাকিস্তানের ফয়সালাবাদ থেকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে তাঁরা শুধু সঙ্গীতের সীমানা ভেঙে দেননি, বরং হৃদয়ের ভাষায় মিলিয়েছেন কোটি মানুষের মন।

নুসরাত: কাওয়ালির সম্রাট

১৯৪৮ সালের ১৩ অক্টোবর পাকিস্তানের ফয়সালাবাদে জন্ম নেন নুসরাত ফাতেহ আলী খান। তাঁর বাবা উস্তাদ ফতেহ আলী খান ছিলেন সুপরিচিত কাওয়ালি শিল্পী। সঙ্গীত ছিল তাঁদের পরিবারের শিরায়-শিরায় প্রবাহিত। নুসরাত মাত্র ১৬ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুতে হঠাৎ দায়িত্বভার নেন পারিবারিক সঙ্গীত দলের।

নুসরাতের কণ্ঠস্বর ছিল এমন এক শক্তি, যা শ্রোতাকে আধ্যাত্মিক উন্মাদনায় ভরিয়ে তুলতে পারত। ৬০০ বছরের পুরোনো কাওয়ালি ঘরানাকে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে পরিচিত করেন। তাঁর গাওয়া “তাজদার-এ-হারম”, “দম মাস্ত কালন্দর” ও “আফরীন আফরীন” এখনও বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের আবেগের কেন্দ্রবিন্দু।

রাহাত: চাচার পদাঙ্কে

১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেন রাহাত ফাতেহ আলী খান। তাঁর বাবা ফাররুখ ফতেহ আলী খান ছিলেন নুসরাতের ছোট ভাই। রাহাত শৈশব থেকেই সঙ্গীতে ঝুঁকে পড়েন। মাত্র তিন বছর বয়সে গানের প্রশিক্ষণ শুরু হয়, আর সাত বছর বয়সেই প্রথম কাওয়ালি আসরে অংশগ্রহণ করেন।

চাচা নুসরাতের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠা রাহাত শৈশবেই মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শক মাতাতে শিখে যান। নুসরাতের দলের অংশ হিসেবে তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তে পারফর্ম করেছেন, যা পরবর্তীতে তাঁর একক ক্যারিয়ারের জন্য বিশাল পাথেয় হয়ে দাঁড়ায়।

প্রজন্মান্তরের সঙ্গীত উত্তরাধিকার

নুসরাত ও রাহাতের পরিবার শুধু শিল্পী পরিবার নয়, বরং এক দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বাহক। তাঁদের পূর্বপুরুষরা ১৩শ শতাব্দী থেকে সুফি দরগাহ ও সামাজিক অনুষ্ঠানে কাওয়ালি পরিবেশন করে আসছেন।

  • প্রথম প্রজন্ম: উস্তাদ ফতেহ আলী খান — পাকিস্তানে কাওয়ালি জনপ্রিয় করে তোলেন।
  • দ্বিতীয় প্রজন্ম: নুসরাত ফাতেহ আলী খান — কাওয়ালিকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেন।
  • তৃতীয় প্রজন্ম: রাহাত ফাতেহ আলী খান — ঐতিহ্য রক্ষা করে আধুনিক সঙ্গীতে নতুন মাত্রা যোগ করেন।

ভাইরাল মুহূর্ত ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

ডিজিটাল যুগে নুসরাত ও রাহাত উভয়ের গান নতুন প্রজন্মের মাঝেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

ভাইরাল মুহূর্ত ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

ডিজিটাল যুগে নুসরাত ও রাহাত উভয়ের গান নতুন প্রজন্মের মাঝেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

  • নুসরাতের ভাইরাল ভিডিও: পুরনো লাইভ কনসার্ট, বিশেষত ৯০-এর দশকের “তাজদার-এ-হারম” ও “আল্লাহ হু” আজও কোটি ভিউ পায় ইউটিউবে।
  • রাহাতের হিট গান: বলিউডে “তেরি মেরি”, “জাগ সূনা সূনা”, “ও রে পিয়া” — এগুলো ইউটিউবে শত শত মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
  • কোক স্টুডিও ম্যাজিক: ২০১৬ সালে কোক স্টুডিও পাকিস্তানে রাহাতের পরিবেশনায় “আফরীন আফরীন” কয়েক মাসের মধ্যে ভাইরাল হয়, যা নুসরাতের ক্লাসিক গানের আধুনিক রূপ।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে

নুসরাত ফাতেহ আলী খান শুধুমাত্র পাকিস্তান বা ভারতেই নন, বরং হলিউড ও ইউরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গেও কাজ করেছেন। পিটার গ্যাব্রিয়েলের সঙ্গে তাঁর সহযোগিতা বিশ্বসঙ্গীতে তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে।

অন্যদিকে রাহাতও বিশ্বব্যাপী কনসার্ট করে চলেছেন — যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত। তাঁর মঞ্চে উপস্থিতি আজও ভক্তদের জন্য এক আবেগময় অভিজ্ঞতা।

পুরস্কার ও স্বীকৃতি

  • নুসরাত: UNESCO মিউজিক প্রাইজ, পাকিস্তান সরকারের সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড, টাইম ম্যাগাজিনে “World’s 50 Most Influential Voices” তালিকায় অন্তর্ভুক্তি।
  • রাহাত: পাকিস্তান সরকারের “নিশান-এ-ইমতিয়াজ”, বলিউড ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিউজিক অ্যাওয়ার্ড।

বিতর্কের ছোঁয়া

সফলতার পাশাপাশি দুজনের ক্যারিয়ারেই কিছু বিতর্ক এসেছে। রাহাত ২০১১ সালে দিল্লি বিমানবন্দরে অবৈধভাবে বড় অঙ্কের অর্থ বহনের অভিযোগে আটক হন। যদিও পরে বিষয়টি সমাধান হয়। নুসরাতের ক্ষেত্রেও কিছু কাওয়ালি গানের কথার কারণে ধর্মীয় রক্ষণশীল মহল সমালোচনা করেছিল।

আজও অনুপ্রেরণা

নুসরাতের মৃত্যুর পর (১৯৯৭), রাহাত সেই সঙ্গীত উত্তরাধিকার বহন করে চলেছেন। তিনি শুধু চাচার গান নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন না, বরং নিজের সৃষ্টিতেও বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের মুগ্ধ করে চলেছেন।

উপসংহার

নুসরাত ফাতেহ আলী খান ও রাহাত ফাতেহ আলী খান—দুই প্রজন্মের এই শিল্পী শুধু সঙ্গীতের জন্য বেঁচে নেই, বরং তাঁরা সঙ্গীতকেই বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুফি সঙ্গীতের আধ্যাত্মিকতা থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক গানের জনপ্রিয়তা—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের অবদান অসামান্য। আজও যখন তাঁদের গান বাজে, তখন মনে হয়—সুর কখনও মরে না, উত্তরাধিকার চিরজীবী থাকে।

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version