আন্তর্জাতিক কূটনীতির অঙ্গনে আবারও শুরু হচ্ছে এক নতুন অধ্যায়। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। আগামী ১৫ আগস্ট ২০২৫ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরতম অঙ্গরাজ্য আলাস্কায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার (৮ আগস্ট) নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ ট্রাম্প এ তথ্য প্রকাশ করেন। তিনি একে “দীর্ঘ প্রতীক্ষিত সাক্ষাৎ” বলে উল্লেখ করেন এবং জানান, আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচি পরে প্রকাশ করা হবে।
বৈঠকের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য
ট্রাম্পের ভাষায়, এই বৈঠকের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ইউক্রেন যুদ্ধের অবসান ঘটানো। তিনি ইঙ্গিত দেন, আলোচনায় “ভূমি বিনিময়” ভিত্তিক একটি শান্তি প্রস্তাব আলোচ্য হতে পারে, যা উভয় পক্ষের জন্য উপকারী হতে পারে। তাঁর ধারণা, পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি দুজনেই যুদ্ধের অবসান চান, এবং পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য একটি ‘বাস্তবসম্মত সুযোগ’ রয়েছে।
ক্রেমলিন ও রুশ প্রতিক্রিয়া
রুশ সংবাদমাধ্যম রিয়া নভোস্তি জানিয়েছে, রাশিয়ার এক প্রতিনিধি বলেছেন—আলাস্কা ভৌগোলিকভাবে রাশিয়ার সীমানার কাছে, এবং বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থে উভয় দেশের জন্য এখানে বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি আরও জানান, ভবিষ্যতে রাশিয়াতেও অনুরূপ বৈঠকের সম্ভাবনা আছে, কারণ পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রাম্পকে মস্কো সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
ঐতিহাসিক ও ভূ–রাজনৈতিক গুরুত্ব
আলাস্কা ভৌগোলিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে বিশেষ সম্পর্কের প্রতীক। ১৮৬৭ সালে রুশ সাম্রাজ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চল কিনে নেয়। বেয়ারিং প্রণালীর ওপারে অবস্থিত হওয়ায়, এটি দুই দেশের মধ্যকার কৌশলগত যোগাযোগের ক্ষেত্র হিসেবেও বিবেচিত। ইতিহাসে এর আগে খুব কমবারই আলাস্কা এমন উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের আয়োজন করেছে—যেমন ১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর সাক্ষাৎ, এবং ১৯৮৪ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ও পোপ জন পল দ্বিতীয়ের বৈঠক।
আলোচ্যসূচি ও সম্ভাবনা
যদিও এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচ্যসূচি ঘোষণা করা হয়নি, কূটনৈতিক মহলে ধারণা করা হচ্ছে—ইউক্রেন যুদ্ধ, নিষেধাজ্ঞা, আর্কটিক অঞ্চলে সহযোগিতা, এবং সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অর্থনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সামরিক উপস্থিতির বিষয়ও আলোচনায় আসতে পারে।
আগের কূটনৈতিক উদ্যোগ
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া শীর্ষ সম্মেলন এবং তার আগে–পরে হওয়া টেলিফোন আলাপ এই বৈঠকের পথ সুগম করেছে। সেই সময় দুই দেশের মধ্যে ইউক্রেন ইস্যুতে প্রাথমিক সমঝোতার ইঙ্গিত মিলেছিল, যা এবার আরও গভীর আলোচনায় রূপ নিতে পারে।
বিতর্ক ও সমালোচনা
ইউক্রেন ও ইউরোপের অনেক দেশ “ভূমি বিনিময়”–ভিত্তিক কোনো সমাধানকে যুদ্ধের ন্যায্য সমাপ্তি হিসেবে দেখছে না। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এটি বাস্তবায়িত হলে তা হবে একপ্রকার সমঝোতার নামে আত্মসমর্পণ। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ইউক্রেনের সংবিধান উভয়েই এমন কোনো সমাধানের পথে আইনগত বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
সুরক্ষা ও প্রস্তুতি
বৈঠকের স্থান চূড়ান্ত করতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে ট্রাম্প নিরাপত্তাজনিত বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। আলাস্কার ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য—রাশিয়ার সান্নিধ্য এবং সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতি—এই বৈঠকের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
উপসংহার
১৫ আগস্টের ট্রাম্প–পুতিন বৈঠক শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক কূটনৈতিক পরীক্ষা হতে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, আন্তর্জাতিক অর্থনীতি, আর্কটিক সহযোগিতা—সবই এই আলোচনার সম্ভাব্য অংশ। ফলাফল যা-ই হোক, এই বৈঠক আন্তর্জাতিক রাজনীতির সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায় হিসেবে স্থান পাবে।