Home তথ্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ডিএনএ প্রযুক্তির মাইলফলক: শিশুদের বংশগত রোগ থামানোর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ!!

ডিএনএ প্রযুক্তির মাইলফলক: শিশুদের বংশগত রোগ থামানোর বৈপ্লবিক পদক্ষেপ!!

"যুক্তরাজ্যের জেনেটিক প্রযুক্তি সাফল্য"

0
GeoBangla_GeneticDisease_NewBornBaby

একটি যুগান্তকারী চিকিৎসা উন্নয়ন ভয়াবহ জেনেটিক রোগে আক্রান্ত পরিবারগুলোর জন্য নতুন আশার আলো জাগিয়েছে। যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন, যা তিনজনের ডিএনএ ব্যবহার করে সুস্থ শিশুর জন্ম দিতে সহায়তা করে।

এই প্রযুক্তির নাম “মাইটোকন্ড্রিয়াল ডোনেশন”। এ পর্যন্ত এই পদ্ধতিতে আটটি সুস্থ শিশুর জন্ম হয়েছে—চার ছেলে ও চার মেয়ে, যার মধ্যে রয়েছে অভিন্ন (একইরকম) যমজ। এই শিশুরা এখন ছয় মাস থেকে দুই বছরের মধ্যে রয়েছে। ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের এই গবেষণাটি দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং এটিকে বড় বৈজ্ঞানিক সাফল্য হিসেবে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে।

প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে, এই পরিবারগুলো মারাত্মক কিন্তু বিরল মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগে ভুগছিল—যে রোগ কোষের ভেতরের ক্ষুদ্র “বিদ্যুৎকেন্দ্র” মাইটোকন্ড্রিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এসব রোগের কারণে পক্ষাঘাত, মস্তিষ্কের ক্ষতি, স্ট্রোক, হার্ট ফেইলিওর এমনকি দৃষ্টিশক্তি হারানোর মতো গুরুতর জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই আক্রান্ত শিশুরা অল্প বয়সেই মারা যায়।

মাইটোকন্ড্রিয়ার নিজস্ব ডিএনএ থাকে, যা কোষের মূল জেনেটিক কোড থেকে আলাদা এবং মায়ের দিক থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে আসে। ফলে, যদি কোনো মহিলার মাইটোকন্ড্রিয়ায় ত্রুটি থাকে, তবে তা সন্তানের মধ্যেও চলে আসতে পারে।

এ সমস্যা সমাধানে বিজ্ঞানীরা একটি বিশেষ পদ্ধতি তৈরি করেন। প্রথমে বাবা-মায়ের নিষিক্ত ডিম্বাণু থেকে নিউক্লিয়াস (যেটিতে প্রায় সমস্ত জেনেটিক তথ্য থাকে) আলাদা করা হয়। এরপর এটি সুস্থ এক দাতার ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপন করা হয়, যার নিজস্ব নিউক্লিয়াস আগে থেকেই সরানো হয়েছে। এই দাতার ডিম্বাণুতে সুস্থ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ থাকে। বৈজ্ঞানিকভাবে, এই পদ্ধতিকে প্রোনিউক্লিয়ার ট্রান্সফার বলা হয়।

এভাবে তৈরি ভ্রূণে মায়ের এবং বাবার নিউক্লিয়ার ডিএনএ থাকে, কিন্তু একটি সামান্য অংশ মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ আসে দাতার কাছ থেকে। এজন্য এ ধরনের শিশুকে অনেক সময় “তিন-অভিভাবক শিশু” বলা হয়, যদিও দাতা শিশুর জিনের একটি ক্ষুদ্র অংশই দেন।

প্রাথমিক ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। কোনো শিশুর মধ্যেই উত্তরাধিকারসূত্রে আসা রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি এবং তারা প্রত্যাশিতভাবে বেড়ে উঠছে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এদের দীর্ঘ সময় পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে নিশ্চিত হওয়া যায় এই পদ্ধতি পুরোপুরি নিরাপদ ও কার্যকর কিনা।

নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক ডগ টার্নবুল, যিনি গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন, বলেছেন, “মাইটোকন্ড্রিয়াল রোগ অত্যন্ত ভয়াবহ হতে পারে। এই আবিষ্কার পরিবারগুলোর জন্য বাস্তব আশা এনে দিচ্ছে।”

অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইটরিখ এগলি এই গবেষণাকে “অসাধারণ” এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছেন।

তবে বিতর্কও রয়েছে। সমালোচকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, এ ধরনের জেনেটিক হস্তক্ষেপ সমাজকে “ডিজাইনার শিশু” তৈরির পথে নিয়ে যেতে পারে। তাদের মতে, যদি এ ধরনের জিন পরিবর্তন স্বাভাবিক হয়ে যায়, তবে অনেকে চোখের রঙ বা বুদ্ধিমত্তার মতো বৈশিষ্ট্য বেছে নেওয়া শুরু করতে পারেন—যা অনেকের দৃষ্টিতে নৈতিকভাবে ভুল।

নিউ ইয়র্কের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট নিউম্যান সতর্ক করে বলেছেন, “এটি শুধু চিকিৎসাগত ঝুঁকি নয়—এটি সাংস্কৃতিকভাবেও ঝুঁকিপূর্ণ।”

কিছু বিশেষজ্ঞ আরও সতর্ক করেছেন এমন ঝুঁকি নিয়ে, যা এখনও দেখা যায়নি—যেমন, ডিম্বাণু দানকারী নারীদের স্বাস্থ্যের প্রভাব বা এই ভ্রূণ গ্রহণকারীদের উপর প্রভাব। কানাডার বায়োএথিসিস্ট ফ্রাঁসোয়া বেলিস প্রশ্ন তুলেছেন—নিজস্ব জেনেটিক শিশুর জন্ম দেওয়াকেই কি একমাত্র গ্রহণযোগ্য মাতৃত্ব-পিতৃত্ব হিসেবে দেখা উচিত? তিনি বলছেন, “পরিবার গড়ার আরও উপায় আছে,” যেমন দত্তক গ্রহণ।

যুক্তরাষ্ট্রে এই পদ্ধতি বর্তমানে সীমিত, তবে বিদেশে কিছু ঘটনা ঘটেছে। ২০১৬ সালে এক মার্কিন চিকিৎসক মেক্সিকোতে এক জর্ডানীয় দম্পতিকে তিন-অভিভাবক শিশুর জন্মে সহায়তা করেন। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ এ পদ্ধতিকে বৈধ করেছে, আবার গ্রিস ও ইউক্রেনের মতো দেশগুলো এটি বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করছে, যদিও সেই ক্ষেত্রে কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।

সব বিতর্কের মাঝেও বিজ্ঞানীরা আশাবাদী। টার্নবুল বলেন, গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে ফলাফল খুবই আশাপ্রদ। তিনি আরও জানান, যুক্তরাজ্যের মতো দেশে কঠোর নিয়মনীতি থাকার কারণে এ প্রযুক্তির অপব্যবহারের আশঙ্কা কম।

ডেভেলপমেন্টাল বায়োলজিস্ট রবিন লাভেল-ব্যাজও একমত। তার মতে, এই পদ্ধতি CRISPR-এর মতো জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির থেকে আলাদা। তিনি বলেন, “এটি বৈশিষ্ট্য উন্নত করার জন্য নয়, এটি বেদনাদায়ক, প্রাণঘাতী রোগ বন্ধ করার জন্য। আর সেটি অবশ্যই সমর্থনযোগ্য একটি লক্ষ্য।”

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version