২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। দুপুর ২টা ৫২ মিনিট। ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার সামনে উত্তাল জনস্রোত। কেউ উল্লাসে, কেউ আশঙ্কায়, আবার কেউ অজানা বিপদের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরে যখন জনতা উচ্ছ্বসিত, ঠিক তখনই ঘটল ইতিহাসের এক রক্তাক্ত মোড়।
মাদ্রাসাশিক্ষার্থী দুই ভাই—দ্বীন ইসলাম ও সামিউল ব্যাপারী—সেদিন বাবার সঙ্গে বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করছিলেন। বাবা শাহ আলম ব্যাপারী তখনও জানতেন না, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে ভাগ্য তাদের তিনজনকে তিনটি ভিন্ন পথে টেনে নিয়ে যাবে—একজন চিরবিদায়, একজন পাগলপ্রায়, আর একজন বাকরুদ্ধ শোকে পাথর।
পুলিশ হঠাৎ করেই শুরু করে মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ। আশেপাশের শত শত বিক্ষোভকারী ছুটতে থাকে বাঁচার তাগিদে। বড় ভাই দ্বীন ইসলাম ছোট ভাইকে নিয়ে ফ্লাইওভারের পিলারের আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ৩ মিনিট পরই ছিন্ন হয় ভাইয়ের হাতের বন্ধন। পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়েন দ্বীন ইসলাম। সামিউল প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ান, রেখে যান ভাইকে, রেখে যান নিজের চিরস্থায়ী দুঃস্বপ্ন।
যাত্রাবাড়ীর সেই একটি দিন যেন হয়ে ওঠে বহু পরিবারের জন্য মৃত্যুর উৎসব, বিভেদের আর্তনাদ। সেই ভয়াল দিনটি এখন উঠে এসেছে প্রথম আলোর নতুন অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্রে—“রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড”। নির্মমতায় ভরা এই প্রামাণ্যচিত্রে উঠে এসেছে ৫ আগস্টের হত্যাযজ্ঞের শত শত করুণ মুহূর্ত, যেখানে মানুষ ছিল শুধু শিকার—যন্ত্রণা ও নিধনের লক্ষ্যে পরিণত।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যাত্রাবাড়ী থানার সামনের ১ কিলোমিটার জুড়ে ঘটেছে অসংখ্য গুলিবর্ষণ, পিটুনি ও হত্যার ঘটনা। সকাল ৮টা থেকে রাত অবধি প্রতিটি মুহূর্তে বদলে গেছে পরিস্থিতি, ঘটেছে নতুন নতুন মর্মান্তিকতা। ৫ মাসব্যাপী অনুসন্ধানে সেই প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি কান্নার উৎস, প্রতিটি মৃত্যুর সময়কাল ও স্থানের তথ্য জড়ো করেছে প্রথম আলোর দল।
এই অনুসন্ধান তুলে ধরেছে—কে কোথায় কীভাবে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, কী অস্ত্র ব্যবহার করেছে পুলিশ, কতজন বিক্ষোভকারীর শরীর চিরে গেছে ছররা গুলিতে। মোবাইল ফোনে ছবি তুলতে গিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া যুবকের মৃতদেহ, দৌড়াতে দৌড়াতে গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষ, আহতের আর্তনাদে কাঁপতে থাকা বাতাস—এই প্রামাণ্যচিত্র যেন একটি জীবন্ত দলিল।

গল্পের মধ্যে রয়েছে আবদুন নূরের ঘটনাও। নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও করতে করতে গুলিবর্ষণের সময় সবাইকে সতর্ক করছিলেন তিনি। শেষ রক্ষা হয়নি। নিজেই গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন।
আরও আছে ইমন গাজীর বেঁচে ফেরার অলৌকিক গল্প। মাত্র ৪ মিটার দূর থেকে তাঁকে লক্ষ্য করে পুলিশের গুলি। শরীরের তিনটি স্থানে লেগেছিল প্রাণঘাতী অস্ত্রের আঘাত। সবাই যখন তাঁকে মৃত ভেবে ভ্যানে তুলে নিচ্ছিল, তখন হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালেন ইমন। মৃত্যুর মধ্যেও জীবনের আশ্চর্য জেগে ওঠা।
এই প্রামাণ্যচিত্র শুধু নিহতদের তালিকা নয়, এটা একটি ইতিহাস—যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে সাধারণ মানুষের উপর চালানো ভয়াবহ নিপীড়নের চিত্রপট। গণপিটুনিতে নিহতদের, গুম হয়ে যাওয়া যুবকদের, কিংবা বন্দুকের নলের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কথা বলার অপরাধে প্রাণ হারানো তরুণদের গল্পও উঠে এসেছে এখানে।
যাত্রাবাড়ীর গণ–অভ্যুত্থানের সেই দিনটি যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন ট্র্যাজেডির সংযোজন। এই নিয়ে প্রথম আলোর তৈরি এটি তৃতীয় অনুসন্ধানী প্রামাণ্যচিত্র। এর আগে মোহাম্মদপুরের গুলিবর্ষণ নিয়ে “কাউন্সিলর আসিফ–রাজীবের নেতৃত্বে গুলিবর্ষণ” শীর্ষক সংক্ষিপ্ত প্রামাণ্যচিত্র এবং সাভারের ঘটনাবলী নিয়ে “সাভার গণহত্যা: হাসিনা পালানোর পরের ৬ ঘণ্টা” নামে বিশ্লেষণধর্মী ভিডিও তৈরি করেছে প্রথম আলো।
“রক্তাক্ত মহাসড়ক: যাত্রাবাড়ী হত্যাকাণ্ড” আজ থেকে দেখা যাবে প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলে। যারা ৫ আগস্টের ইতিহাস প্রত্যক্ষ করেননি, তাঁদের জন্য এটি শুধু একটি ভিডিও নয়, বরং একটি নির্ভরযোগ্য দলিল—একটি রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার জীবন্ত চিত্র।
একটি প্রশ্ন আজও ঘুরে ফিরে আসে—সেদিন কাদের আদেশে, কেন এই গুলিবর্ষণ? কোন অপরাধে এত প্রাণের বিনাশ? সেই উত্তর হয়তো এখনো অজানা, কিন্তু ইতিহাস ভুলে যাবে না এই রক্তাক্ত আগস্টের কথা।