২০২৪ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বহু বিতর্ক ও উত্তেজনার পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। তার লক্ষ্য ছিল দেশের গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে একটি স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। তবে এক বছর সময় কাটিয়ে যখন এই সরকারের কাজকর্মের মূল্যায়ন করা হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে সফলতার পাশাপাশি রয়েছে নানা সমালোচনাও, যা বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে ভিন্ন মাত্রার গুরুত্ব বহন করে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রেক্ষাপট ও দায়িত্ব
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনের পর, ৮ই আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। এই সরকারটির মূল দায়িত্ব ছিল— দেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করা, বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনে মৌলিক সংস্কার আনা এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করা। একাধিক সংকটের মাঝেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেশের পরিস্থিতি সামাল দিতে হয়েছে যেখানে রাজনৈতিক উত্তেজনা, সামাজিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ সবই ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থনীতির স্থিতিশীলতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাফল্য
অর্থনীতির দিক থেকে এই সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক কাজ করেছে বলে স্বীকার করা হচ্ছে। বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা বিশেষ করে অধ্যাপক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এই বিষয়ে স্পষ্ট। তিনি বলেন, “সরকারের হাতে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থান ছিল অত্যন্ত জটিল, যেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রার মান স্থিতিশীল রাখা, সুদের হার নিয়ন্ত্রণ এবং বাজেট ঘাটতি কমানো ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।”
বাহ্যিক খাত অর্থাৎ রেমিটেন্স ও রপ্তানির বৃদ্ধি, আমদানি কমিয়ে বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য আনা, পুরনো বিদেশি ঋণ শোধের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অপরিবর্তিত রাখা এই সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন। এই কাজগুলো দেশের অর্থনীতিতে একটি ধ্রুবকতা এনেছে, যা সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
তবে, অর্থনীতির এই সাফল্য সীমাবদ্ধ হয়েছে বাহ্যিক ক্ষেত্রে। অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের প্রসারে সরকার তেমন কোনও বড় পদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে সমালোচনা উঠেছে। ড. দেবপ্রিয় স্পষ্ট করে বলেন, “বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের অভাব, যা ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের মূল কারণ ছিল।”
এছাড়া, অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী নীতির অভাব এবং সরকারের তরফ থেকে মেলামেশা করেও কার্যকর কোনো মধ্যমেয়াদি নীতিমালা না থাকা একটি বড় ঘাটতি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন ছিল সুসংহত পরিকল্পনা, যা তারা দিতে পারেনি।
বিচার ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক সংস্কারে অসম্পূর্ণতা
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল ‘জুলাই হত্যা’সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার ন্যায়সঙ্গত বিচার করা এবং প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পুলিশ বাহিনীর সংস্কার আনা। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বিচার প্রক্রিয়া ও সংস্কার নিয়ে কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি স্বীকার করলেও ব্যাপক সমালোচনার ভাষ্য দিয়েছেন।
তিনি বলেন, “বিচার প্রক্রিয়া এখনও প্রশ্নবিদ্ধ, ঢালাও মামলা এবং বিচারকেন্দ্রিক দুর্নীতি যেমন মামলা বাণিজ্য, গ্রেফতার বাণিজ্য, জামিন বাণিজ্য ব্যাপকভাবে চলছে যা সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধক।”
বিচার প্রক্রিয়া নানা সময়ে প্রতিশোধমূলক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এছাড়া দলীয়করণের নতুন রূপের উত্থান এবং প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শুরু করে নিম্নস্তর পর্যন্ত দলীয়করণের কারণে একটি জবাবদিহিমূলক ও সুশাসিত প্রশাসন গঠনে ব্যর্থতা দেখা গেছে।
সংস্কার কমিশন গঠনের পর তাদের রিপোর্ট পাওয়ার পরও সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শতাধিক সুপারিশের মধ্যে মাত্র কয়েকটি বাছাই করে গুরুত্বহীন কিছু সংস্কার করা হয়েছে—যেমন ‘টয়লেট পরিষ্কার রাখা’—যা আসল সংস্কারের কাজকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও মব ভায়োলেন্স: সরকারের বড় ব্যর্থতা
গত এক বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং মব ভায়োলেন্সের বিস্তার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বড় দুর্বলতা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকার ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি মব সৃষ্টি করে ধ্বংস করা, মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙা, রাজনৈতিক কর্মী ও সাধারণ মানুষের বাড়িতে হামলা, লুটপাট এবং গণপিটুনির মতো নৃশংস ঘটনাগুলো ঘোর সমালোচনার সৃষ্টি করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বলেন, “সরকার মব ভায়োলেন্সকে সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা না করলেও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অপারেশন ডেভিল ও তৌহিদি জনতার মত গোষ্ঠীকে বৈধতা দেওয়ার ফলে মব সংস্কৃতি বৈধতা পেয়ে একটি আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদনেও খুন, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, লুটপাট ও গণপিটুনিতে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। সরকারের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও পদক্ষেপের মধ্যে পার্থক্য থাকায় জনসাধারণের মনে নিরাপত্তাবোধ ক্ষুণ্ন হয়েছে।
জোবাইদা নাসরীন আরও উল্লেখ করেন, “সরকার দলের সমর্থন নিয়ে হলেও জনগণের মতামত ও ইতিহাসের প্রতি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমালোচনা গ্রহণে ব্যর্থতা রয়েছে। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক মর্যাদা রক্ষা ও সম্মান বজায় রাখতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে, যা দেশের বৃহত্তর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে উদ্বেগজনক।”
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুশাসনের প্রশ্ন
অতীতে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় নানা প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ ছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারেও এই দিক থেকে পার্থক্য কম নয়। গত এক বছরে ২০০-এর বেশি সাংবাদিককে বিভিন্ন হত্যার মামলায় আসামি করা, জোরপূর্বক চাকরিচ্যুত ও গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দখলসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “সরকারি হস্তক্ষেপে সাংবাদিকদের অ্যাক্রিডিটেশন বাতিল, চাকরিচ্যুতকরণ ও প্রতিষ্ঠান দখল করা হয়েছে। এ ধরনের কাজ পরিবেশকে অত্যন্ত বিতর্কিত করেছে।”
এছাড়া স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং স্বার্থের সংঘাতের কারণে সুশাসন ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারের অবস্থান প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এই ব্যর্থতার দায় শুধুমাত্র অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নয়, বরং রাজনৈতিক দল, আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোরও বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সামগ্রিক মূল্যায়ন ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের কর্মক্ষমতার পর্যালোচনা একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার উদ্রেক করেছে। অর্থনীতির কিছু সফলতা থাকা সত্ত্বেও তা অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিকে পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বিচারব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কার না আসা এবং মব ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে সরকারের অনীহা ও দুর্বল পদক্ষেপ জনমনে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সুশাসনের ক্ষেত্রে সরকারের নানা পদক্ষেপ বিতর্কিত ও সমালোচিত হয়েছে, যা ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের জন্য বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী সময়ে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, ন্যায়বিচার ও প্রশাসনিক সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন, এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শক্তিশালী করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি, রাজনৈতিক সংলাপ ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দেশের স্থিতিশীলতা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা সময়ের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
উপসংহার
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত এক বছরে বাংলাদেশের নানা সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সাফল্যের পাশাপাশি রয়েছে যথেষ্ট সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ। দেশের অর্থনীতি, বিচার ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সবক্ষেত্রে সরকারকে আরো জোরালো, স্বচ্ছ এবং গণমুখী হতে হবে।
এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরবর্তী সময়ের জন্য একটি সংক্ষিপ্তকালীন মঞ্চ হলেও দেশের ভবিষ্যতের জন্য এর ভূমিকা দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। তাই এখনই সময় কঠিন আত্মসমীক্ষা ও কার্যকর সংস্কারের, যাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সামগ্রিক উন্নয়ন সুদৃঢ় ভিত্তিতে দাঁড়াতে পারে।
