গল্পের নাম: ‘আগুনজন্মা’
১. সূচনা: এক ঝড়ের রাত
মেঘডুবি গ্রামে সেই রাতটাতে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছিল। বিদ্যুৎ ছিল না, চারপাশ নিস্তব্ধ। কেবলমাত্র পুরাতন গ্রাম্য স্কুলঘরটিতে টিমটিম করে জ্বলছিল একটি হারিকেন। সেই আলোর নিচে বসে ছিল একটি কুয়াশামাখা মুখ—নামের আগে কেউ ডাকত ‘বিপ্লবী’; নাম তার ছিল অরুণ।
অরুণ তখন কেবল ২৫। তুখোড় ছাত্র ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু রাজপথে গুলিবিদ্ধ এক বন্ধুর মৃত্যু তাকে বদলে দিয়েছিল। সে আর শান্তভাবে বই পড়ে সমাজ বদলাবে না, সে আগুন হয়ে উঠবে। প্রতিবাদের আগুন, বিপ্লবের আগুন।
২. প্রেমের জন্ম
জীবনের বাঁকে হঠাৎই এক দুপুরে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল মেঘলার। গ্রামের স্কুলে নতুন শিক্ষক হিসেবে এসেছিল মেঘলা। চোখে ছিল গভীর জিজ্ঞাসা, ঠোঁটে ছিল মৃদু হাসি। অরুণ যখন স্কুলঘরে কিছু বিপ্লবী ছাত্রদের গোপনে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল, তখনই প্রথম চোখে পড়ে মেঘলার।
মেঘলা বুঝে গিয়েছিল অরুণকে ঠেকানো যাবে না। কিন্তু তার হৃদয়েও জন্ম নেয় এক আশ্চর্য ভালোবাসা—যা বিপ্লবের চেয়েও গভীর, যা আগুনকেও শান্ত করতে পারে।
তাদের ভালোবাসা ছিল নীরব, গোপন, কিন্তু উদ্দীপনায় ভরা। ছায়ার মতো হেঁটে যাওয়া, একে অপরের চোখে চেয়ে দীর্ঘ সময় কাটানো—তাদের প্রেমে শব্দের প্রয়োজন ছিল না।
৩. আন্দোলনের দিনগুলো
গ্রামে তখন জমিদারের অত্যাচার, পুলিশ প্রশাসনের চোখ রাঙানি, রাজনৈতিক দুর্নীতি চরমে। অরুণের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘মেঘডুবি গণমুক্তি পরিষদ’। তরুণ-তরুণীরা রাত জেগে দেয়াল লিখনে, লিফলেট বিতরণে ব্যস্ত।
মেঘলা তাদের লেখাপড়ার কাজ চালিয়ে যেতে বলত। সে জানত, শিক্ষা ছাড়া বিপ্লব স্থায়ী হবে না।
এক রাতে অরুণ বলেছিল, “তোমার চোখে আমি দেখি স্বাধীনতা। যদি আমি এই যুদ্ধ জিততে পারি, প্রতিশ্রুতি দাও, আমায় ভুলবে না।”
মেঘলা বলেছিল, “তুমি ফিরে এসো বিজয় নিয়ে, আমি অপেক্ষা করব—প্রেম নিয়ে।”
৪. বিশ্বাসঘাতকতা ও কারাবরণ
কিন্তু প্রতিটি আন্দোলনের মতোই, এই আন্দোলনেও ছিল একজন গাদ্দার। নাম ছিল মন্টু। সে ছিল একসময় অরুণের সহযোদ্ধা, পরে পুলিশের সোর্স হয়ে ওঠে। এক রাতে পুলিশের হঠাৎ হানায় ধরা পড়ে অরুণ।
মেঘলার চোখের সামনে থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায়। সে কেঁদেছিল না, চিৎকার করেনি—শুধু ঠোঁট কামড়ে বলেছিল, “সে ফিরে আসবেই।”
অরুণের উপর শুরু হয় অত্যাচার, নিপীড়ন। কিন্তু সে কিছুই স্বীকার করেনি। মনের মধ্যে কেবল জ্বলছিল দুটো আগুন—বিপ্লবের আগুন ও মেঘলার চোখের আলোকছায়া।
৫. কারাগারের চিঠিগুলো
কারাগারে বসে সে মেঘলাকে ২১টি চিঠি লিখেছিল। প্রতিটি চিঠিতে ছিল বিপ্লবের কথা, আশার কথা, অপেক্ষার কথা। কিন্তু প্রতিটি চিঠিই পৌঁছায়নি। সেগুলো পুলিশের আলমারিতে ধুলোপড়া কাগজে পরিণত হয়।
মেঘলা জানত না, অরুণ বেঁচে আছে কি না। সে প্রায় প্রতিদিন স্কুলঘরের টেবিলে বসে চেয়ে থাকত জানালার ফাঁক দিয়ে। তার ছাত্ররা জানত, এই অপেক্ষার নাম—ভালোবাসা।
৬. মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন
চার বছর পরে এক রাজনৈতিক পালাবদলে কারাগার ভেঙে পড়ে। বন্দীরা ছাড়া পায়। অরুণ আবার ফিরে আসে মেঘডুবিতে। কিন্তু মেঘলা আর সেই স্কুলঘরে ছিল না। স্কুলটি তখন পরিত্যক্ত। লোকজন বলল, মেঘলা হঠাৎ একদিন চলে গেছে, কাউকে কিছু না জানিয়ে।
অরুণ তখন বুঝেছিল, তার ভালোবাসা আর ফিরে আসবে না। কিন্তু তার ফিরে আসার অর্থ ছিল—এক নতুন যুদ্ধের সূচনা।
৭. চূড়ান্ত বিপ্লব
এইবার আর গোপনে নয়, অরুণ প্রকাশ্যেই যুদ্ধ শুরু করে। সে নতুন করে সংগঠন গড়ে তোলে, ন্যায় বিচারের দাবি তোলে, জনগণকে একত্র করে। সরকার তাকে বিপদ মনে করে। মিডিয়া তখন তাকে ‘গ্রামীণ চে গুয়েভারা’ নামে ডাকতে শুরু করে।
অবশেষে দীর্ঘ আন্দোলনের পর জমিদারি ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়, স্থানীয় প্রশাসনে গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। মেঘডুবি হয়ে ওঠে দেশের প্রথম ‘গ্রামীণ স্বশাসিত অঞ্চল’।
বিপ্লব সফল হয়। অরুণ তখন ৩৩।
৮. প্রেমের অপূর্ণতা ও নায়কের জন্ম
এক সন্ধ্যায়, বিজয় উদ্যাপনের মাঝে, অরুণ চুপিচুপি চলে যায় সেই পরিত্যক্ত স্কুলঘরে। সে একাকী বসে থাকে। দেয়ালের ফাটলে সে পায় এক চিঠি—মেঘলার লেখা।
চিঠিতে লেখা ছিল:
“অরুণ,
আমি জানি তুমি একদিন ফিরে আসবে। কিন্তু জানি না, আমি থাকব কি না। যদি তুমি বিপ্লবে জয়ী হও, আমার একটা অনুরোধ রেখো—স্কুলটা নতুন করে গড়ে তোলো, যেন আর কোনো প্রেম অপেক্ষায় নষ্ট না হয়।”
অরুণ কাঁদে না, কেবল স্কুলঘরের দেয়ালে বড় করে লিখে রাখে:
‘ভালোবাসা ও বিপ্লব—দুটোই জন্মায় আগুন থেকে।’
৯. উপসংহার
অরুণ পরে সেই স্কুলঘরকে ‘মেঘলা বিদ্যানিকেতন’ নামে গড়ে তোলে। হাজারো শিশু সেখানে পড়তে আসে। তিনি নিজে কোনোদিন আর প্রেম করেননি। তাকে ঘিরে ছিল কেবল মানুষের ভালোবাসা, শিশুদের চিৎকার, আর এক আকাশ জ্বলন্ত সূর্য।
তাকে লোকে মনে রাখে নায়ক হিসেবে। কিন্তু অরুণ জানত, তার বিপ্লবের পর্দার আড়ালে ছিল এক অপূর্ণ প্রেমের অনিঃশেষ আলো।