সিরাজগঞ্জ, বাংলাদেশ – বহু বছর ধরে বিলম্ব ও খরচ বৃদ্ধির পর বহুল প্রতীক্ষিত সিরাজগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক এখন আনুষ্ঠানিকভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য উন্মুক্ত। ঢাকা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত এই শিল্পপার্কটি প্রত্যাশা করা হচ্ছে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ (FDI)-এর নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে, বিশেষ করে চীনা কোম্পানিগুলোর ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এই প্রকল্পের তদারককারী সংস্থা বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) গত সপ্তাহে প্রথম ধাপের প্লট বরাদ্দ কার্যক্রম শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ৭২ জন উদ্যোক্তা শিল্প প্লটের জন্য চিঠি পেয়েছেন এবং ২০২৫ জুড়ে ধাপে ধাপে আরও প্লট বরাদ্দ করা হবে।
কর্মকর্তারা আশা করছেন, সিরাজগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ৩০ কোটি থেকে ৫০ কোটি মার্কিন ডলার পর্যন্ত বিনিয়োগ আসতে পারে, যা বিসিকের ইতিহাসে বৃহত্তম শিল্প উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। এই পার্কে মোট ৮২৯টি শিল্প প্লটের মধ্যে ৫৫০টি চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য সংরক্ষিত, যার অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
কৌশলগত অবস্থান ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা
৪০০ একর জায়গা জুড়ে যমুনা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই পার্কে রয়েছে সড়ক, রেল ও নৌপথে উন্নত বহুমুখী সংযোগ সুবিধা। কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অবস্থানটি উৎপাদক, রপ্তানিকারক ও লজিস্টিক কোম্পানিগুলোর জন্য পরিবহন ও বিতরণ কার্যক্রমে বড় সুবিধা এনে দেবে।
প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৪ বছর আগে এবং ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পূর্ণ ঘোষণা করা হয়। শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৮৮ কোটি টাকা, যা পরবর্তীতে বেড়ে দাঁড়ায় ৭১৯ কোটি টাকায়, যা দীর্ঘ সময় ধরে বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ব্যয়বৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।
শিল্প প্লটগুলোর আকার শুরু হয়েছে সর্বনিম্ন ১০,০০০ বর্গফুট থেকে, বড় বিনিয়োগকারীদের জন্য রয়েছে আরও বড় প্লট। পার্কটিতে রয়েছে ৫০ থেকে ৮০ ফুট প্রশস্ত অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ১৭ একর জলাধার, একটি ডাম্পিং ইয়ার্ড এবং ইটিপি (Effluent Treatment Plant) স্থাপনের জন্য নির্ধারিত এলাকা। পরিবেশগত বিধিমালা অনুসারে, সব বিনিয়োগকারীকেই ইটিপি স্থাপন করতে হবে।
চীনা বিনিয়োগ: নীতিমালার অপেক্ষায়
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, চীনা কোম্পানিগুলো একটি আনুষ্ঠানিক বিনিয়োগ প্রস্তাব জমা দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বিসিক পরিচালিত শিল্প এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য একটি নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে, যার অনুমোদন এখনো শিল্প মন্ত্রণালয়ের বিবেচনায় রয়েছে।
বিসিকের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জিএম রাব্বানী বলেন, “নীতিমালা চূড়ান্ত হলে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হবে।”
এই বিনিয়োগ অনুমোদিত হলে প্রায় ১ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, যার ৮০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এটি এলাকার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখবে।
জমির প্রস্তুতি নিয়ে বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ
তবে প্লট বরাদ্দ চললেও কিছু বিনিয়োগকারী অভিযোগ করেছেন, অনেক প্লট এখনো কারখানা নির্মাণের উপযোগী নয়। মো. আবদুল কাদের, যিনি একটি আটা মিল নির্মাণের পরিকল্পনা করছেন, বলেন, “অবস্থান ও যোগাযোগ চমৎকার, কিন্তু জমি প্রস্তুত নয়।”
পার্ক কর্তৃপক্ষ জানায়, এখনো প্রায় ১২ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ বাকি, যার মধ্যে প্রায় ১.৫ কোটি বর্গফুট জমি এখনো ভরাট ও সমতল করা হয়নি। ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের পর নির্মাণকাজে বিঘ্ন ঘটে এবং পুরনো ঠিকাদার এখনো কাজে ফেরেনি। ফলে নতুন ঠিকাদার নিয়োগের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে।
গ্যাস সরবরাহ এখনও অনিশ্চিত
জ্বালানি সরবরাহ আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও গ্যাস পাইপলাইন বসানো হয়েছে, গ্যাস সরবরাহ এখনো শুরু হয়নি। পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (PGCL) সূত্রে জানা গেছে, তিনটি প্রয়োজনীয় পাইপলাইনের মধ্যে একটি তৈরি হয়েছে, বাকি দুটি এখনো টেন্ডার পর্যায়ে।
২০২৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থা চালু হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আরও অনুমোদন প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক সম্ভাবনা: সিরাজগঞ্জের জন্য যুগান্তকারী
সম্পূর্ণভাবে চালু হলে সিরাজগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে ২ লাখের বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে, যা স্থানীয় ও আঞ্চলিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
কর্তৃপক্ষ আশা করছে, ২০২৫ সালের মধ্যেই সব প্লট বরাদ্দ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সম্পন্ন হবে। ২০২৬ সালের শুরুতে কারখানা নির্মাণ শুরু হতে পারে এবং এরপর দ্রুত উৎপাদন কার্যক্রম চালু হবে।
প্রকল্প পরিচালক সজিদ উল ইসলাম বলেন, “এই প্রকল্প সিরাজগঞ্জ এবং আশেপাশের অঞ্চলের জন্য একটি গেম চেঞ্জার হতে পারে।