বিজ্ঞানীরা একটি নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির ব্যাপারে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, যা আমরা দেখতে বা অনুভব করতে পারি না—মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই ক্ষুদ্র প্লাস্টিকের কণাগুলো, যা প্রায়ই বালুর কণার থেকেও ছোট, নীরবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক ইতোমধ্যেই রক্ত, লালা, স্তন্যদুধ এবং এমনকি হাড়ের ভেতরেও শনাক্ত করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, সময়ের সাথে সাথে এই অদৃশ্য আগ্রাসীরা গুরুতর ক্ষতি করতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক কোথা থেকে আসে?
মাইক্রোপ্লাস্টিক সব জায়গায় রয়েছে—আমাদের খাবারে, পানিতে, এমনকি আমরা যে বাতাস শ্বাস নেই তাতেও। গবেষণায় (হার্টফোর্ডশায়ার, ইংল্যান্ডের রোথামস্টেড রিসার্চ ইনস্টিটিউট) দেখা গেছে গড়ে একজন মানুষ বছরে প্রায় ৫২,০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা গিলে ফেলে। ১৯৬০-এর দশক থেকে প্লাস্টিকের ব্যাপক ব্যবহারই এর মূল কারণ।
এমনকি ইংল্যান্ডের কিছু পুরনো মাটি এবং ফসলের নমুনাও (যেগুলো ১৮৪৩ সাল থেকে রেকর্ড করা) এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণের চিহ্ন দেখাচ্ছে। দৈনন্দিন জীবনের প্লাস্টিক প্যাকেজিং, বোতল ও পাত্র থেকে এই কণাগুলো মুক্ত হয়। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলে বা গরম পানিতে চা ব্যাগ ডুবালে সরাসরি মাইক্রোপ্লাস্টিক মুক্ত হতে পারে।
চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার
সাম্প্রতিক গবেষণায় উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে:
- ২০২৪ সালে চীনে মানুষের হাড় ও পেশির মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছিল, যা শারীরিক শক্তি ও ফিটনেস কমিয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা।
- ইতালীয় গবেষকরা ধমনীর প্যাঁচের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক সনাক্ত করেছেন, যা হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা হঠাৎ মৃত্যুর ঝুঁকি ৪.৫ গুণ বাড়ায়।
- ২০২৫-এর প্রথম দিকে মার্কিন বিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্কে প্লাস্টিক কণা খুঁজে পেয়েছেন, বিশেষত ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে। ডিমেনশিয়াজনিত মস্তিষ্কে স্বাস্থ্যের তুলনায় ১০ গুণ বেশি প্লাস্টিক কণা ছিল।
যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন যে মাইক্রোপ্লাস্টিক সরাসরি হার্টের রোগ বা ডিমেনশিয়া সৃষ্টি করে, তবে তারা মনে করেন এগুলো অন্যান্য ঝুঁকির সঙ্গে মিলিত হয়ে সময়ের সাথে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের জটিল সমস্যা
মাইক্রোপ্লাস্টিক বিভিন্ন রকমের হয়। এক লিটার বোতলের পানিতে প্রায় ২,৪০,০০০ প্লাস্টিক কণা থাকতে পারে, যেগুলো সাত ধরনের প্লাস্টিকের মিশ্রণ হতে পারে। কিছু প্লাস্টিক পরিবেশ থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভারী ধাতু শোষণ করে, যা সরাসরি আমাদের শরীরে প্রবেশ করায়। অন্য কিছু প্লাস্টিক এমন জিন বহন করতে পারে যা জীবাণুদের অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী করে তোলে, ফলে “সুপারবাগ” তৈরি হতে পারে।
“ন্যানোপ্লাস্টিক” নামে আরও ছোট একটি ধরণের কণা আছে—যেগুলো এক মাইক্রোমিটারের থেকেও ছোট এবং মানুষের কোষের মধ্যে ঢুকে ডিএনএ ক্ষতি করতে পারে। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে, যা ক্যান্সারের মতো রোগের সঙ্গে যুক্ত।
স্বাস্থ্যগত উদ্বেগ ও চলমান গবেষণা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক রক্তনালীগুলো ক্ষতি করে এবং কোষের অক্সিডেটিভ চাপ বাড়িয়ে বার্ধক্য দ্রুত করতে পারে। প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন নির্দিষ্ট মাত্রার মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে প্রদাহ এবং বিপাকীয় পরিবর্তন হয়। তবে মানুষের ওপর এর পুরো প্রভাব পরিমাপ করা কঠিন, কারণ প্রত্যেকেই বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বিভিন্ন উপায়ে গ্রহণ করে।
বর্তমানে গবেষণাগুলো বিশেষত অ্যাজমা রোগীদের মতো সংবেদনশীল গোষ্ঠীর ওপর বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। যুক্তরাজ্যে এক দল শ্বাসনালী রোগীদের স্পুটাম নমুনা বিশ্লেষণে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ শনাক্ত করেছে। আশ্চর্যের বিষয়, হাসপাতালেও প্লাস্টিক মাস্ক ও টিউব ব্যবহার মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস হতে পারে।
সতর্কতামূলক পদক্ষেপ
বিজ্ঞানীরা মাইক্রোপ্লাস্টিকের নিরাপদ মাত্রা নির্ধারণ এবং শিল্পখাতকে প্লাস্টিক ব্যবহারে হ্রাস বা নিরাপদ বিকল্পে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন। কিছু বিশেষজ্ঞ খাবার গরম করার জন্য প্লাস্টিক পাত্র এড়িয়ে কাঁচ বা ধাতব পাত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন, এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ও বোতল বেছে নিতে বলছেন।
যদিও মাইক্রোপ্লাস্টিক নীরব, তবে প্রতিটি নতুন গবেষণায় এর প্রভাব মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আজই আমাদের প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ কমানো আগামী প্রজন্মকে এই অদৃশ্য কিন্তু বিপজ্জনক দূষণ থেকে রক্ষা করতে পারে।
সূত্র – বিবিসি