লন্ডন, ৭ আগস্ট ২০২৫ — আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ভারতীয় লেখক, আইনজীবী ও অধিকারকর্মী বানু মুশতাক। তাঁর ছোটগল্প সংকলন “হার্ট ল্যাম্প” (Heart Lamp) –এর জন্য তিনি জিতে নিয়েছেন ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কার। এটি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং কন্নড় ভাষার প্রথম সাহিত্যকর্ম হিসেবে এই সম্মান অর্জন করার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ভারতের একটি আঞ্চলিক ভাষাও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করল।
● কী আছে “হার্ট ল্যাম্প”–এ?
“হার্ট ল্যাম্প” মূলত একগুচ্ছ ছোটগল্পের সংকলন, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম ও দলিত নারীদের জীবন, সংগ্রাম, সমাজে তাঁদের অবস্থান এবং স্বপ্ন ও ভাঙনের বর্ণনা অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিটি গল্পে বাস্তব জীবনের দ্বন্দ্ব, অসমতা, নিপীড়ন এবং আশা-আকাঙ্ক্ষার মিশেলে গড়ে উঠেছে এক অনন্য সাহিত্যজগত। লেখক নারীর চোখ দিয়ে দেখিয়েছেন সমাজের ভেতরের নিঃশব্দ কষ্ট, এবং সেই কষ্টের ভেতর থেকেও উঠে আসা এক ধরনের আলো—যা হয়তো বইয়ের শিরোনামের সঙ্গে মিল রেখেই বলা যায়, একেকটি হৃদয়ের বাতি।
● অনুবাদে দীপা ভাস্তির কৃতিত্ব
মূলত কন্নড় ভাষায় লেখা হলেও বইটি আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছে এর ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে, যা করেছেন অনুবাদক দীপা ভাস্তি। তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে লেখকের ভাষাশৈলী, আঞ্চলিক অভিব্যক্তি এবং সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত সুর ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেছেন।
বুকার কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে,
“আমি যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম হাজারো জোনাকির ভিড়ে। এই আলো আমার একার নয়—এটি সেইসব নারীর, যারা প্রতিদিন আলো ছড়ায় অথচ কেউ দেখে না।”
● পুরস্কার বিতরণী ও লেখিকার প্রতিক্রিয়া
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয় লন্ডনের টেট মডার্ন গ্যালারিতে, যেখানে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি।
পুরস্কার গ্রহণের পর বানু মুশতাক বলেন,
“আমি যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম হাজারো জোনাকির ভিড়ে। এই আলো আমার একার নয়—এটি সেইসব নারীর, যারা প্রতিদিন আলো ছড়ায় অথচ কেউ দেখে না।”
তিনি আরও বলেন, “এই পুরস্কার কেবল আমার নয়, বরং কন্নড় ভাষা, দক্ষিণ ভারতের প্রান্তিক নারীরা, এবং সেসব জীবন যা এতদিন অদৃশ্য থেকে গিয়েছে—তাদের সকলের হয়ে আমি এই সম্মান গ্রহণ করছি।”
বানু মুশতাক
বানু মুশতাক কেবল একজন সাহিত্যিক নন—তিনি একজন মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী এবং সমাজকর্মী। কন্নড় ভাষাভাষী মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া এই লেখক বরাবরই নিজ ভাষায় লিখে গেছেন সেইসব গল্প, যা মূলধারার সাহিত্যে প্রায় অনুপস্থিত।
তাঁর লেখায় যেমন রয়েছে বাস্তবতার নির্মম সত্য, তেমনি রয়েছে সাহস, প্রতিবাদ এবং একটি নতুন সমাজের স্বপ্ন। তাঁর লেখালেখির মূল কেন্দ্রবিন্দু—নারীর জীবন, পরিচয়, মর্যাদা এবং সামাজিক বৈষম্য।
কন্নড় ভাষার এক নতুন ভোর
বানু মুশতাকের জয় কেবল তাঁর ব্যক্তি অর্জন নয়, বরং কন্নড় ভাষার সাহিত্য ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক। এর আগে এই ভাষায় বিশ্বসাহিত্যের এমন স্বীকৃতি দেখা যায়নি।
ভারতীয় সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষাগুলির মধ্যে কন্নড় দীর্ঘদিন ধরে সমৃদ্ধ থাকলেও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া ছিল বিরল ঘটনা। “হার্ট ল্যাম্প”–এর মাধ্যমে সেই শূন্যতা পূরণ করলেন বানু মুশতাক।
বানু মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’ যেন কেবল একটি গল্পসংকলন নয়—এটি হয়ে উঠেছে আলো ছড়ানোর প্রতীক। সেইসব মানুষের আলো, যারা এতদিন নিভৃত ছিল। আজ আন্তর্জাতিক বুকার স্বীকৃতির মাধ্যমে সেই আলো ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বজুড়ে।