বাংলাদেশের শিল্প ও বাণিজ্যের অবস্থা দীর্ঘদিনের সংকটের মধ্যে আটকে রয়েছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলারের ঘাটতি ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগকারীরা নতুন উদ্যোগ নিতে অনিচ্ছুক। এর ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, বিশেষ করে আমদানিনির্ভরতা ও ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আগামী ১ আগস্ট থেকে মার্কিন বাজারে পণ্য রপ্তানিতে ৩৫ শতাংশ রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পারস্পরিক শুল্ক) আরোপের বিষয়টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে নতুন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। এ কারণে ইউরোপ ও আমেরিকান বাজারে চাহিদা কমার আশঙ্কাও রয়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পরিবহনের ঘাটতির কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা সংকট বাড়াচ্ছে।
শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) এর সাবেক সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী জানান, গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বিনিয়োগকে ধীরগতি করেছে। শ্রমিক বেকারত্ব বেড়ে গেছে এবং কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আইন-শৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না পেলে ব্যবসা-বিনিয়োগে স্থিতিশীলতা আসা কঠিন।
তৈরি পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নির্বাচন বিলম্বের কারণে গত বছর নতুন বিনিয়োগ হয়নি। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট এবং উচ্চ সুদের হার অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার কারণ।
রপ্তানিকারক ট্রেড গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন মন্তব্য করেন, মার্কিন বাজারে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ ও গ্লোবাল মন্দার কারণে রপ্তানিতে সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে পোশাক রপ্তানি কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত বা বিলম্ব করছে, যার কারণে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে মূলধনী যন্ত্রের আমদানি ১৯.৬ শতাংশ কমে হয়েছে ২৬২ কোটি ২৪ লাখ ডলার। এর আগে একই সময়ে আমদানি ছিল ৩২৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও বিনিয়োগ কমানোর কারণে এই পতন ঘটেছে।
একই সঙ্গে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহও কমে গেছে। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ১৪-১৬ শতাংশ সুদে ঋণ দিচ্ছে, যা ঋণের প্রবাহ কমানোর একটি বড় কারণ। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়িয়েছে, যার ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিতে পিছিয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নীতি সুদহার ৮.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশে নিয়ে এসেছে, যা অর্থনীতির সম্প্রসারণে সহায়ক হতে পারে, কিন্তু ব্যবসায়ীরা এ থেকে খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছেন না বলেও জানাচ্ছেন।
ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য জরুরি। ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, স্বচ্ছতা বৃদ্ধিসহ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ ব্যবস্থা প্রণয়ন প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল ও স্পেশাল ইকোনমিক জোনে সুযোগ বৃদ্ধি ও রপ্তানি বহুমুখীকরণে নতুন খাত যেমন তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ঔষধ শিল্পে জোর দিতে হবে।