সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠিত এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের কার্যত শাসক এবং সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আসিম মুনীর করা একটি বিতর্কিত ও বিস্ময়কর বক্তব্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে ঝড় তোলে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রতি সমর্থনের কারণে সাহসী হয়ে ওঠা মুনীর হুঁশিয়ারি ছিলো — তিনি বললেন, যদি ভারত পাকিস্তানে জল সরবরাহে বাধা দেয় এমন কোনো অবকাঠামো তৈরি করে, তবে পাকিস্তান তা ধ্বংস করতে প্রস্তুত এবং সেই সঙ্গে যদি অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি হয়, তবে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে বিশ্বকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যাবে।
ফ্লোরিডার টাম্পা শহরে এই বক্তব্যে মুনীর বলেন, “আমরা ভারতের বাঁধ তৈরির অপেক্ষায় থাকব। যখন তারা বাঁধ নির্মাণ করবে, তখন আমরা দশটি মিসাইল দিয়ে সেটি ধ্বংস করে দেব। ইন্দুস নদী ভারতের ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। আমাদের কাছে মিসাইলের অভাব নেই, আলহামদুলিল্লাহ।”
এর আগে ২০২৫ সালের জুনে মুনীর হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানে ট্রাম্পকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নোবেল পুরস্কার দেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি, যা ফ্লোরিডার ওই অনুষ্ঠানে পুনর্ব্যক্ত করেন। একই সময় মুনীর মার্কিন মাটিতে আরও বড় ধরনের পারমাণবিক হুমকিও দেন, বলেন, “আমরা পারমাণবিক শক্তিধর দেশ। যদি মনে করি আমরা ধ্বংস হবো, তাহলে পৃথিবীর অর্ধেককে সঙ্গে নিয়ে পতনের মুখে পড়বো।”
এই হুমকিগুলো যদিও স্বাধীন উৎস থেকে যাচাই করা যায়নি, তবুও পাকিস্তানি মিডিয়া ও বিশেষজ্ঞরা এই বক্তব্য প্রকাশ করেছে এবং কিছু সমর্থক তাদের জাতীয়তাবাদী মনোভাব দিয়ে মুনীর বক্তব্যকে প্রশংসা করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক সমর্থক লিখেছে, “মাঠ মার্শাল সরাসরি মার্কিন সেনাবাহিনীর নেতাদের মার্কিন মাটিতে পারমাণবিক হুমকি দিচ্ছেন।”
মুনীর ফ্লোরিডা সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিলো মার্কিন সেনাবাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ডের (CENTCOM) কমান্ডার জেনারেল মাইকেল কুরিলার অবসর অনুষ্ঠানটি উপস্থিত থাকা। কুরিলা ২৬ জুলাই পাকিস্তানের উচ্চ সম্মান ‘নিসান-এ-ইমতিয়াজ’ পান, বিশেষত দুই দশক মার্কিন অবহেলা পরবর্তী পাকিস্তানে আগ্রহ ফিরিয়ে আনার ভূমিকায়। মুনীর সেখানে কুরিলার উত্তরসূরি অ্যাডমিরাল ব্র্যাড কুপার ও চেয়ারম্যান জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ জেনারেল ড্যান কেইনের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন, যা পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্কের নতুন মাত্রাকে বোঝায় এবং সম্ভবত এটিই তাকে এমন সাহসী ও উগ্র বক্তব্য দিতে প্রেরণা দিয়েছে।
ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে মুনীর তার বক্তব্যে ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে সাম্প্রতিক সংঘর্ষকে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে আক্রমণ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং কাশ্মীরকে পাকিস্তানের “গরু-নালি” বলে অভিহিত করেন। এই বক্তব্যের প্রভাব পড়েছিলো ২০২৫ সালের এপ্রিলের পাহালগাম সন্ত্রাসী হামলায়, যেখানে পাকিস্তানি সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নিরীহ ২৬ জনকে হত্যা করে।
মুনীর বক্তব্যের একটি দিক ছিলো ভারতের পূর্বাঞ্চল থেকে শুরু করে পশ্চিম দিকে আক্রমণের হুমকি, যা সম্ভবত ভারতের বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিবাদের ইঙ্গিত বহন করে। তিনি ভারতের মার্কিন সঙ্গে বাণিজ্যিক বিবাদের কথাও তুলে ধরে পাকিস্তানের ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক ভারসাম্য রাখার সক্ষমতাকে তুলে ধরেন।
পাকিস্তানের সামরিক ও সরকারি ওয়েবসাইটগুলো মুনীর ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে বলেছে, “আমাদের কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা সাফল্যের পেছনে রয়েছে আল্লাহর বরকত, জাতীয় ঐক্য, দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অসাধারণ পেশাদারিত্ব।”
এই সমস্ত বিবৃতি, বিশেষত মার্কিন মাটিতে দেওয়া পারমাণবিক হুমকি, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পাকিস্তানের নতুন ধরনের আত্মবিশ্বাস ও হুমকিপূর্ণ কূটনীতির বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। যদিও এর বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলো, তবে মুনীর এই বক্তব্য পাকিস্তান-আমেরিকা ও পাকিস্তান-ভারত সম্পর্কের নতুন জটিলতায় আরও একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, ভবিষ্যতে এই হুমকিগুলো কেবল বাক্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি বাস্তব কোনো সামরিক উত্তেজনায় রূপ নেয়। কারণ এমন ধরণের হুঁশিয়ারি শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভাষা নয়, বরং আন্তর্জাতিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ধরণের ঝুঁকি হিসেবে বিবেচিত।