আপনি কি কখনও ভেবেছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ কে? আমাদের মনে হয়তো আইনস্টাইন বা স্টিফেন হকিং-এর নাম আসতে পারে। কিন্তু আজকের দিনে এই খেতাবটি রয়েছে টেরেন্স টাও-এর কাছে, একজন জীবন্ত প্রতিভা, যার আইকিউ ২৩0! প্রায়ই যাকে “গণিতের মোৎজার্ট” বলা হয়, টাও বিশ্বজুড়ে পরিচিত তার অসাধারণ মেধা, বিনয়ী স্বভাব এবং অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য।
শৈশব থেকেই এক বিস্ময় বালক
দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেডে জন্ম নেওয়া টেরেন্স টাও ছোটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধার পরিচয় দিয়েছেন। যেখানে বেশিরভাগ শিশু ১০ বছর বয়সে সাইকেল চালানো শিখছে, টেরেন্স তখন সমাধান করছিল জটিল গণিত সমস্যার। এমনকি মাত্র ১০ বছর বয়সেই তিনি আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেন, যা তাকে করে তোলে সেই প্রতিযোগিতার ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী অংশগ্রহণকারী। ১৩ বছর বয়সে তিনি সেখানে জিতে নেন সোনার পদক!
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ১৪ বছর বয়সে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ভর্তি পরীক্ষা উত্তীর্ণ হন গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা ও ইংরেজি বিষয়ে। তিনি তখন থেকেই পড়াশোনা শুরু করেন জটিল বিশ্ববিদ্যালয় বিষয় যেমন: কোয়ান্টাম মেকানিক্স, লিনিয়ার অ্যালজেব্রা ও ম্যাথম্যাটিক্যাল ফিজিক্স—যা সাধারণত শিক্ষার্থীরা অনেক দেরিতে শিখে থাকে।
অকালপক্ব একাডেমিক সাফল্য
যখন অনেক শিক্ষার্থী এখনো কলেজে কী পড়বে তা ভাবছে, তখন টাও শেষ করে ফেলেছেন তার পিএইচডি! হ্যাঁ, মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে পিএইচডি অর্জন করেন—যা বিশ্বের অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়।
এবং ভাবতে পারেন, এর পরের ধাপটি আরও বিস্ময়কর! মাত্র ২৪ বছর বয়সে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, লস অ্যাঞ্জেলেস (UCLA)-এর পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপক হয়ে যান। যেখানে অনেকেই সেই বয়সে চাকরির খোঁজে থাকে, সেখানে টাও ইতিমধ্যেই শিক্ষাদান শুরু করেছেন এবং যুগান্তকারী গবেষণা প্রকাশ করেছেন।
গণিতের “নোবেল পুরস্কার”
গণিতে অসামান্য অবদানের জন্য প্রদান করা হয় ফিল্ডস মেডেল, যা গণিতের নোবেল হিসেবে পরিচিত। খুব কম মানুষই এই সম্মান পেয়েছেন। টেরেন্স টাও এই পুরস্কার পান মাত্র ৩১ বছর বয়সে, যা তাকে ইতিহাসের সবচেয়ে কমবয়সী বিজয়ীদের একজন করে তোলে। এটি তার অসাধারণ প্রতিভা এবং অবদানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি।
পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিভাবান
টাও তার পেশাগত জীবনে অসংখ্য সম্মানজনক পুরস্কার জিতেছেন। এই পুরস্কারগুলো তার অসাধারণ অবদানের প্রতিফলন। আন্তর্জাতিক গণিত জগতে তার অবদান ব্যাপকভাবে স্বীকৃত ও শ্রদ্ধেয়। তার কিছু উল্লেখযোগ্য পুরস্কার হলো:
- Salem Prize (2000)
- Bòcher Memorial Prize (2002)
- Clay Research Prize (2003)
- Ostrowski Prize (2005)
- SASTRA Ramanujan Prize (2006)
- Breakthrough Prize in Mathematics (2014)
এই পুরস্কারগুলো কেবলমাত্র বিশ্বের সেরা গণিতবিদদের দেওয়া হয়, এবং টেরেন্স টাও এদের অনেকগুলো অর্জন করেছেন।
বহুমুখী দক্ষতার অধিকারী
টাও-এর বিশেষত্ব শুধু তার বুদ্ধিমত্তা নয়, বরং তার বহুমুখী প্রতিভা। তিনি গণিতের একটিমাত্র ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নন। তার গবেষণা বিস্তৃত অনেক জটিল বিষয়ে, যেমন:
- আংশিক ডিফারেনশিয়াল সমীকরণ
- নাম্বার থিওরি
- জ্যামিতি ও সম্ভাবনা
- কম্পিউটার ভিশন
- স্ট্রিং থিওরি
- ফাংশনাল অ্যানালিসিস
তিনি অনেক গবেষণাপত্র ও বই লিখেছেন এবং এই প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
শুধু আইকিউ নয়: এক বিনয়ী প্রতিভা
যদিও তার আইকিউ ইতিহাসের সর্বোচ্চগুলির মধ্যে একটি, টেরেন্স টাও পরিচিত তার বিনয়ী এবং মানবিক আচরণের জন্য। তিনি বিশ্বাস করেন তার জ্ঞান অন্যদের সাহায্যে ব্যবহার করা উচিত এবং এমনকি তিনি মেধাবী শিশুদের জন্য বিশেষ শেখার প্রোগ্রাম তৈরি করেছেন।
অনেক অন্যান্য উজ্জ্বল মস্তিষ্কেরও উচ্চ আইকিউ রয়েছে, যেমন ক্রিস্টোফার হিরাতা, কিম উং-ইয়ং এবং আইনান কাওলি; তবে অর্জন, ধারাবাহিকতা এবং প্রভাবের দিক থেকে কেউই টাও-এর সমান নয়।
একজন গণিতবিদ একবার বলেছিলেন:
“যখন কেউ ১০ ফুট লম্বা এবং বাকিরা ১ ফুট, তখন তুলনা করার কোনো মানে হয় না।”
টেরেন্স টাও-ই সেই ব্যক্তি—যিনি অন্যদের থেকে এতটাই এগিয়ে যে তুলনা করাও অর্থহীন। তার জীবন আজও বিশ্বব্যাপী শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং স্বপ্নবাজদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে।