গাজীপুর—একসময় শান্তি ও প্রগতির প্রতীক হলেও এখন অপরাধ ও হত্যার মিছিলে পরিণত হয়েছে এই শহর। গত সাত মাসে গাজীপুর মহানগর ও এর আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় মোট ১০৩টি খুনের ঘটনা ঘটে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে গভীর আতঙ্কের সঞ্চার করেছে। এই সংখ্যাটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, বরং তা গাজীপুরের সাধারণ মানুষ ও সাংবাদিকদের জীবনযাত্রার ওপর এক ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরের চান্দনা, চৌরাস্তা, বাসন, টঙ্গীসহ শহরের বিভিন্ন জায়গা অপরাধীদের আস্থানা হয়ে উঠেছে। সেখানে আইন-শৃঙ্খলা অবনতির সঙ্গে অপরাধের মাত্রাও বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাতে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় সাংবাদিক মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে দা ও চাপাতি দিয়ে হত্যা করা হয়। এর আগের দিনই সাহাপাড়া এলাকায় সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে নির্মমভাবে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়, তিনি বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
তবে এসব ঘটনা কেবল ক্ষুদ্রাংশ মাত্র। টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে এক যুবকের ভাঙা মরদেহ উদ্ধার করা হয়, যা খুনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতারই অংশ। এ ছাড়াও, টঙ্গী ও আশপাশে প্রতিদিনই ছিনতাই ও হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনকি প্রকাশ্যে চাপাতি নিয়ে হামলার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলার অবনতির স্পষ্ট ইঙ্গিত।
খুনের পেছনে নানা কারণ রয়েছে। পারিবারিক দ্বন্দ্ব, জমিজমা বিরোধ, রাজনৈতিক সংঘর্ষ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, পূর্বশত্রুতা এসবই হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রধান কারণ। গত শনিবার রাতে শ্বাসরোধ ও পিটিয়ে মারধরের পর স্বামী মিজানুর রহমান স্ত্রী মারুফা আক্তারের লাশ ঘরের ভেতরে রেখে বাইরে আগুন ধরিয়ে দেয়। পারিবারিক কলহের কারণে এই ঘটনা ঘটে বলে পুলিশ জানায়।
এছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বরমী ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামে সুইটি আক্তার নামে এক গৃহবধূকে স্বামী নূরুল ইসলাম পিটিয়ে হত্যা করেন। বিয়ের পর থেকে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক ভালো না থাকার কারণে এই নৃশংস ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী প্রতিবাদের স্বরূপ নূরুল ইসলামের দুই বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
এছাড়া গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় চোর সন্দেহে হৃদয় মিয়া নামে এক যুবককে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার পর অনেক লাশকে বন বা সড়কের পাশে ফেলে রাখা হয়, যেখানে খুনিরা তাদের অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে চেষ্টা করে। পুলিশ এসব লাশ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় এবং অনেক কুকীর্তির শিকার মানুষের পরিচয় পাওয়া যায় না।
গাজীপুর জেলা পুলিশের সুপার চৌধুরী মো. যাবের সাদেক জানিয়েছেন, শ্রীপুর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও সদর থানাগুলোতে সাত মাসে ৫৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৮টি রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছেন পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫২ জনকে, যাদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান। তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতায় অপরাধীরা ভয় পায় না এবং তারা নিয়মিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
গাজীপুর মহানগরের ৮টি থানায় গত সাত মাসে ৩৫টি হত্যা ঘটেছে। সদর থানায় সবচেয়ে বেশি, ১১টি মামলা। অন্যথানাগুলোতে হত্যা ঘটনার সংখ্যা চার থেকে পাঁচটির মধ্যে রয়েছে।
খুনের পাশাপাশি ছিনতাইকারীদের হাতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষও। টঙ্গীর সড়ক ও জনপথ কার্যালয়ের সামনে কলেজছাত্র মাহফুজুর রহমান ছিনতাইকারীর হামলায় নিহত হন। তার আগে টঙ্গী ফ্লাইওভারে রঞ্জু নামে এক যুবকও ছিনতাইয়ের ঘটনায় মারা যান।
এক ভয়াবহ ঘটনায়, কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় ৯০ বছর বয়সী নাসির পালোয়ান গুরুতর আহত হন। মাথার খুলি ১৮ টুকরা ভেঙে যায়, লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তিনি মারা যান। স্থানীয়দের দাবি, এলাকার বিভিন্ন জায়গায় কিশোর গ্যাং ছিনতাই ও চাঁদাবাজিতে জড়িত।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সাহিত্যিক মমিনুল ইসলাম বলেন, গাজীপুরের অপরাধ প্রবণতা সামাজিক অবক্ষয় ও বিচ্যুতির ফল। প্রশাসনের দুর্বলতা, বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের ভঙ্গুরতা এই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে। সমাজে মূল্যবোধের পতন এবং আইনশৃঙ্খলার অভাব এই ভয়াবহ অপরাধের মাত্রা বাড়িয়েছে।
গাজীপুরে গণপিটুনিতেও প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। কাপাসিয়ার সেলদিয়া গ্রামে মো. নূরুল ইসলামকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। অন্যদিকে, কোনাবাড়ীতে গ্রিনল্যান্ড গার্মেন্টস কারখানার ভেতর চোর সন্দেহে এক মেকানিককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলার অবনতির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। অপরাধের এই বৃদ্ধি থামাতে প্রশাসনের কঠোর ও কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি। নিরাপত্তার অভাব, সামাজিক অবক্ষয় এবং দুর্বল প্রশাসনের কারণে গাজীপুরে অপরাধ যেন অবাধে ছড়িয়ে পড়ছে।
সরকারি ও স্থানীয় প্রশাসনকে দ্রুত সন্ত্রাস, ছিনতাই, চাঁদাবাজি এবং হত্যার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদমুক্ত একটি পরিবেশ গড়ে তোলার দিক থেকে কাজ করতে হবে। নতুবা, গাজীপুর হয়ে উঠবে অপরাধের এক অবাধ অঞ্চল, যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন আর নিরাপদ থাকবে না।